আজ ১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সংগৃহীত ছবি

মুজিবনগর সরকার ও আমাদের স্বাধীনতা


মো. আবদুর রহিমঃ ‘মুজিব নগর’ বাঙালির মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একটি গৌরব গাঁথা এক অনন্য নাম। আমরা জানি ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার পতনের কারণে বাংলার বিহার ও উড়িষ্যায় স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। বাংলার আকাশের নতুন সূর্য উদয় হয় স্বাধীনতার জন্য ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন। এ দিন বাঙালি জাতি একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দেয়। এ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ৬ দফার মাধ্যমে বাঙালির বাঁচার দাবী ও স্বাধীনতার মূল বীজ রোপন করেন। সেই পলাশীর অস্তমিত সূর্যকে বাংলার আকাশে উদয়নের বীজ ৬ দফা। এ দাবী সামনে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল-জুলুম, নির্যাতন, হুলিয়া মাথায় নিয়ে পরিচালনা করেন অধিকার, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন। জাতীয় ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সভ্যতা ও অধিকার সম্পর্কে বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান। নানা প্রতিকূলতা ও বৈরি পরিবেশকে মোকাবিলা করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তনী সামরিক সরকারকে বাধ্য করেন একটি জাতীয় নির্বাচন দেয়ার জন্য। এক ব্যাক্তির এক ভোট এ নীতির ভিত্তিতে ১৯৭০ সালে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ এ অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় পরিষদ নির্বাচন। জনসংখ্যার ভিত্তিতে এ নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মোট আসন নির্ধারিত হয় ১৬৯টি। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর। আমাদের প্রদেশে আসন সংখ্যা ছিলো ৩০০টি। নির্বাচনের চুড়ান্ত ফলাফলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদে ২৯৮টি আসনে জয়লাভ করে পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃত হন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩ (তিন) জানুয়ারি ১৯৭১-এ সকল সংসদ সদস্যদের সাথে নিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের শপথ গ্রহণ করেন। এ শপথ অনুষ্ঠানে ‘আমার সোনার বাংলা-আমি তোমায় ভালবাসি’ সঙ্গীত দিয়ে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করা হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংসদ সদস্যদের নিয়ে শ্লোগান তুলেন, ‘আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ-বাংলাদেশ। মূলতঃ এ দিনটিই ‘বাংলাদেশ’ নামক নতুন রাষ্ট্রের সূচনার প্রথম দিন। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সংসদীয় দলের নেতা মেনে তার হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে না দিয়ে বাঙালি নিধন করার হীন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত শুরু করে। বাঙালিদের জুলুম, নির্যাতন, গ্রেফতার ও গুলি করে হত্যার পথ বেছে নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়াসহ নানা দিকনির্দেশনা এবং পাকিস্তানীদের হাতে দীর্ঘ ২৩ বছর ব্যাপি বাঙালির উপর পরিচালিত জুলুম নির্যাতনের পর স্বাধীনতার ডাক দেন। ৭ মার্চ ১৯৭১ ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি সুনির্দিষ্ট রূপ রেখা দেন। বলতে হয় ১ মার্চ ১৯৭১ থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের নির্দেশে চলে সরকারী ও বেসরকারী সব কার্যক্রম। ২৫ মার্চ ১৯৭১ কালরাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর নামে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এরই মধ্যে যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা ও দিক নির্দেশনা তার সহকর্মীদের দিয়ে দেন। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার পূবেই তিনি ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে প্রচারের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা তৎকালীন ইপিআর ওয়্যারলেস, টেলিগ্রাম এবং টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এ ঘোষণা শুনামাত্র পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানকে তার ধামণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে।

আরও পড়ুন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল দেশ-জাতির একজন গর্বিত সন্তান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী ১৯৭০ এ নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিদের মতামতের ভিত্তিতে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ খ্রি. সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি গণপরিষদ গঠনপূর্বক বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার প্রতি দৃঢ় সমর্থন ও অনুমোদনের মধ্য দিয়ে মুজিব নগর সরকার একটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ এ তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে দেশি-বিদেশি শতাধিক সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষের উপস্থিতিতিতে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। এ দিন স্বাধীনতার ঘোষণারপত্র অনুমোদিত হয়। সেই দিনটিকে মেহেরপুর বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী এবং সেই দিন থেকে এ স্থানটির নামকরণ হয় ‘মুজিবনগর’। মুজিব নগর সরকার শপথ গ্রহণের দু’ঘন্টার মধ্যেই পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বোমাবর্ষন ও আক্রমণ চালিয়ে মেহেরপুর দখল করে। বাংলাদেশ সরকার ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ভারতের কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করে সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এদিকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নারকীয় তাণ্ডবলীলা ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ চুড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ‘মুজিবনগর’ সরকার গঠিত না হলে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম না।

২০২৪ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ ৫৪ বছরে পা রাখলো। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর এদেশে ১৯৭১ এ পরাজিত অপশক্তি দেশ বিরোধ অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। তারা স্বাধীনতা মেনে নিতে না পেরে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচার, গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে অবিরত। ২০২৪ সালের ‘মুজিবনগর’ দিবসে বাংলার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তার আহ্বান হলো, ‘সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে হলেও ত্রিশ লাখ শহীদ ও দু’লাখ নির্যাতিত মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখতে হবে।’

আসুন, প্রাণ প্রিয় দেশপ্রেমিক বন্ধুরা জাতির পিতা যে অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা দারিদ্রমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা সহযোগী হই এবং দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করি। নিশ্চয়ই জয় হবে সত্য ও ন্যায়ের অন্যায় দূরিভূত হবে।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা স্মৃতি পরিষদ।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর